বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম।
বাংলাদেশ বেতার।
পথ ও পাথেয় অনুষ্ঠান,
প্রচার:২৯/৬/২০১৮ইং বাংলাদেশ সময়; সকাল-৬:৩০টা;
বিষয়: ন্যায় বিচারের গুরুত্ব; আলোচক-
মাও: কাজী হাফেজ মো: ছলিম উল্লাহ খান হাসনাবাদী
ইসলাম শাশ্বত, অবিনশ্বর-চিরন্তন ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ইসলামের মৌল নির্দেশনা হচ্ছে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন। ইসলামী জিন্দেগির প্রতিটি পরতে পরতে ইনসাফ বা ন্যায়নীতির নির্দেশনা রয়েছে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের অসংখ্য জায়গায় এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায় বিচারক। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- وَهُوَ خَيْرُ ٱلْحَاكِمِينَ আর তিনিই সর্বোত্তম হুকুমদাতা শ্রেষ্ঠ বিচারক। (সূরা আরাফ-৮৭)
সমাজে ন্যায়ের বিপরীতে অন্যায় ও যুলুম ক্বায়েম হলে মানুষের জীবনে নেমে আসে দ্বন্দ্ব, হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাত ও নিরাপত্তাহীনতা। যা আজকের ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ বিশ্বের যাবতীয় অনিষ্টের মূল কারণ। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বিশ্বের ১৫৮টি দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার তুলনামুলক পর্যালোচনা করে বলে গেছেন-জনগণের মধ্যে বঞ্চনাই সামাজিক অস্থিরতার মূল কারণ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী প্রজ্ঞাপন দিয়ে সমাজে ন্যায় বিচার ও কল্যাণ কায়েম করার জন্য নবী-রাসুলদের (আ:) পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُر بِٱلۡعَدۡلِ وَٱلۡإِحۡسَـٰنِ . আল্লাহ তোমাদেরকে সকল বিষয়ে ন্যায় বিচার করতে এবং মানুষের কল্যাণ সাধন করতে নির্দেশ দিয়েছেন (সুরা নহল-৯০) যারা এর বিপরীত আমল করবে তাদের বিষয়ে হুশিয়ার করে ইরশাদ হয়েছে- وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَـٰئِكَ هُمُ ٱلْكَافِرُونَ ‘যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারা কাফের তথা সত্য গোপনকারী (সুরা মায়েদা-৪৪) وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَـٰئِكَ هُمُ ٱلظَّالِمُونَ যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারা যালেম তথা অত্যচারী” (সুরা মায়েদা-৪৫) এই নবুয়াতী সুত্র ধরেই আমাদের মহানবী (স.) মদীনার ইহুদী, খ্রীষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলিম সবাইকে নিয়ে একটি লিখিত চুক্তি প্রবর্তন করে জাতীয় ঐক্রমত্য ও ঐক্যবদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করেন। আন্তর্জাতিক রাসূল প্রিয় নবী সা: এর এ চুক্তি বা সনদই পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান বা সাংবিধানিক সরকার হিসেবে স্বীকৃত হয় মহানবী (স.) এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ও সংগঠিত পবিত্র মদীনার ঐক্যবদ্ধ সমাজ আধুনিক অর্থে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল যেখানে ইসলামী সরকার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচার ও ন্যায়-নীতি চর্চার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল
ইসলামে ন্যায় বিচারের বৈশিষ্ট্য হল-নির্ধারিত আইন ও নীতি বিধান সমাজের উচু-নীচু, ধনী-গরীব, শাসক ও শাসিত নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করা রাষ্ট্রীয় সেবা-পরিসেবা ও সরবরাহ গ্রহণের ক্ষেত্র সবার জন্য সমান রাখা জনগণের মৌলিক চাহিদার পূরণ করা কর্মক্ষমদের জন্য কর্মসংস্থান এবং কর্মে অক্ষমদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে দারিদ্র মোচন করা সম্পদের স্বার্থে উৎপাদনের উপকরণ সমূহের ভূমি, শ্রম, পুজিঁ ও মানব সম্পদ ইত্যাদির সর্বাধিক ব্যবহারের মাধ্যমে অতিরিক্ত সম্পদ সৃষ্টি করা। ন্যায় বিচারের কর্মসূচী অব্যাহত রাখার স্বার্থে সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত না করা বস্তুত: অহীর পরিবর্তে মানব রচিত মতবাদ দ্বারা যা পরিচালিত হয় তা ব্যর্থ বলেই আজ প্রমানিত অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকার স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠাতাগণ শাসনতন্ত্র প্রণয়নকালে সরকার গঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন “ন্যায় বিচারই হচ্ছে সরকারের লক্ষ্য“ বাংলাদেশের ঘোষণা পত্রেও “সামাজিক ন্যায় বিচারকে” রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে অর্ন্তভূক্ত করা হয় আমেরিকায় সামাজিক সাম্যতার নামে শুধু পুরুষ এবং সাদাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পরে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে কালোদের অধিকার দেয়া হয় ১৯তম সংশোধনীতে মেয়েদের ভোট প্রদানের অধিকার দেয়া হয় কিন্তু বৈষম্য দূর হয়নি কিছু দিন আগেও আমেরিকার লসেএঞ্জেলস এক ভয়াবহ বর্ণ দাঙ্গা হয়ে গেল শুধুমাত্র সামাজিক ন্যায় বিচারের অভাবে ইসলামী সমাজে ন্যায় বিচারের কর্মসূচী সফল করার লক্ষ্যে সৎ ও নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন- ٱتَّبِعُواْ مَن لَّا يَسۡـَٔلُكُمۡ أَجۡرً۬ا وَهُم مُّهۡتَدُونَ তোমরা অনুসরণ কর তাদেরকে যারা সৎ এবং যারা তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চায়না (সুরা ইয়াসিন-২১)
সামাজিক ন্যায় বিচার সুষ্ঠভাবে আমল করার জন্য শাসকদেরকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কুরআন-সুন্নাহর নির্দশেনা অনুসরণ, জবাবদিহিতার চেতনার উজ্জীবন, প্রাত্যহিক সালাত ব্যবস্থা সম্পাদন ও কর্ম মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুরস্কার ও শাস্তির আদেশ দেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় আইন ও কর্মসূচী প্রণয়ন কালে প্রশাসকদেরকে জনগণ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পরামর্শ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন- وَأَمۡرُهُمۡ شُورَىٰ بَيۡنَہُمۡ তোমরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন কর। (সুরা শুরা-৩৮) স্বৈরাচারী ও শাসনতন্ত্র বিরোধী হতে নিষেধ করে ইরশাদ হয়েছে- وَلَا تُطِعۡ مَنۡ أَغۡفَلۡنَا قَلۡبَهُ ۥ عَن ذِكۡرِنَا وَٱتَّبَعَ هَوَٮٰهُ وَكَانَ أَمۡرُهُ ۥ فُرُطً۬ যে তার খেয়াল খুশীর অনুসূরণ করে স্বৈরাচারী হয় এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে শাসনতন্ত্র বিরোধী হয় তখন তার আনুগত্য করোনা (সুরা কাহফ-২৮)
সমাজে ন্যায় বিচার কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের নির্দেশিকা হবে আল্লাহর কোরআন, রসূলের (স.) এর সুন্নাহ এবং বৈধ শাসকের ন্যায়সংগত নির্দেশাবলী ইরশাদ হয়েছে- يَا أَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَأُوْلِى ٱلأَمْرِ مِنْكُمْ হে বিশ্বাসীগণ তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আল্লাহর রাসূলের (স.) এর এবং আনগত্য কর তোমাদের শাসকদের (সুরা নিসা-৫৯) উপরোক্ত আয়াত সমূহে তিন স্তর বিশিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে ক. আল্লাহ খ. আল্লাহর রাসূলের (স.) গ. দায়িত্বশীলদের একদা প্রিয়নবী সা: তাঁর প্রিয় সাহাবী মোয়াজ (রা.) কে ইয়ামেনের গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠানোর সময় জিজ্ঞেস করলেন “মোয়াজ তুমি কিভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করবে? তিঁনি বললেন “ আল্লাহর কোরআনই হবে আমার পথনির্দেশিকা রাসূল (স.) বললেন যদি কোন বিষয়ে কোরআনের সুস্পষ্ট ফায়সালা না থাকে তবে? তিঁনি বললেন- আল্লাহর রাসূলের (স.) এর সুন্নাহ অনুযায়ী ফায়সালা করব, রাসূল (স.) বললেন- সেখানেও যদি সমাধান না থাকে? তিঁনি বললেন আমি ইজতেহাদ তথা বুদ্ধি বিবেক খাটিয়ে ফায়সালা করব এ কথা শুনে রাসূল (স.) মোয়াজ (রা.) কে দোয়া করে বললেন “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি আল্লাহ ও তার রাসূল (স.) এর প্রতিনিধিকে রাসূলের (স.) মনমত সিদ্ধান্ত গ্রহণের তৌফিক দিয়েছেন (তিরমিযি, আবু দাউদ)
তারীখুত তাবারীতে এসেছে- আব্বাসীয় খলিফা মনসুর বলেছেন, চার প্রকার লোক হলো একটি রাষ্ট্রের খুঁটি। ১। বিচারক, যিনি সুবিচার করেন ২। পুলিশ অফিসার, যারা দুর্বলকে শক্তিশালীর কবল থেকে রক্ষা করেন এবং নিজের দায়িত্ব ঈমানদারীর সাথে পালন করেন ৩। কর আদায়কারী অফিসারগণ, যারা জনগণের প্রতি অন্যায় না করে নিজের দায়িত্ব পালন করেন ৪। সেই গোয়েন্দা অফিসারগন যারা উল্লেখিত তিন প্রকার ব্যক্তিদের রিপোর্ট সত্যায়ন করে শেষ সীলমোহর লাগিয়ে থাকেন। নীতিবান শাসকের খুশখবরী দিয়ে প্রিয় নবীজী (সা.) এরশাদ করেন, যেদিন কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন (ক্বিয়ামতের দিন) আল্লাহ তাঁর (আরশের) ছায়ার নিচে জায়গা দেবেন সাত ধরনের লোকদেরকে। তাদের মধ্যে একদল হচেছ ঐ সমস্ত শাসক যারা এ ধরাতে ইনসাফ কায়েম করেছিলো (বুখারী, তিরমিযী, নাসাঈ)। সততার সাথে এ কাজ করতে গিয়ে ভূল হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও হতাশ হবার কোন কারন নেই মর্মে প্রিয় নবী সা: ইরশাদ করেন- কেউ যদি সর্বাত্মক চেষ্টা করে হক ফায়সালা করতে সক্ষম হয় তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ পুরস্কার। আর যদি চেষ্টা সত্ত্বেও অনিচ্ছাকৃতভাবে ফায়সালায় ভুল হয়ে যায় তার জন্য রয়েছে একটি পুরস্কার। (বোখারী) |